এস এম শাহনূর
“একটি বজ্র কণ্ঠ, তর্জনীর একটি বজ্র নিনাদ
মিটিয়ে দিলো পলাশীর পরাজয়ের অপবাদ।
টুঙ্গি পাড়ার দামাল ছেলে জাতির জনক বঙ্গবীর
শোষিত বাঙালীর নেতা তিনি চির উন্নত শির।
খোকার হাতে বাঙালী লিখল বিজয়ের ইতিহাস,
অবাক পৃথিবীর সবাক কথন সাবাস সাবাস।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপকার, কিংবদন্তি নেতা ও মহাশিশু শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ মার্চ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান। ‘শেখ মুজিব’ নামেও পরিচিত। সংক্ষিপ্তরূপে বলা বা লেখার জন্য অনেকে ‘শেখ মুজিব’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির ব্যবহার আরও বেশি। যারা বঙ্গবন্ধু বা শেখ মুজিব শব্দ ব্যবহার করে, তারা শেখ মুজিবুর রহমান শব্দ বা নাম ব্যবহার করে না। এমনকি একই সঙ্গে দুটি নাম ব্যবহারের প্রয়োজন থাকে না। আরও একটি সম্প্রদায় ‘শেখ সাহেব’ শব্দ ব্যবহার করে। শেখ সাহেব শব্দ ব্যবহারের আরেকটি তাৎপর্য আছে। বিশেষত শেখ মুজিবুর রহমানের সামসময়িক (সমসাময়িক শব্দটি বহুল প্রচলিত হলেও ভুল) রাজনীতিকরা শেখ সাহেব শব্দটি বেশি ব্যবহার করে থাকেন। এটি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবদ্দশা থেকে এখনও প্রবীণ রাজনীতিকদের মধ্যে চালু আছে।
মুজিব নামটা শুনলে চোঁখের সামনে ভেসে ওঠে সাদা পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা সাথে কালো ওয়েস্ট কোট, চোঁখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। যাঁর মধ্যে দিয়ে দেখা যায় চকচকে ঝকঝকে শানিত একজোড়া চোঁখ। অতি সাধারণ পোশাক পরিহিত একজন অসাধারণ মানুষের ছবি। সেই মানুষের ছবি জেগে ওঠে যাঁর হৃদয় ছিল আকাশের মত বিশাল, যাঁর সকাল হত দেশের মানুষের কথা মনে নিয়ে, যে চোঁখে ঘুম নামতো দেশের আপামর মানুষের প্রতি ভালবাসা নিয়ে।
সেই মানুষটা আমাদের বাঙ্গালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, আপামর জনতার ভালবাসা তাঁকে শুধু জাতির পিতাই করেনি করেছে বন্ধু,বাংলার বন্ধু, বাংলার মানুষের বন্ধু, তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু। যাঁর প্রেরণায় বিনা অস্ত্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সমুখ সমরে নেমে ছিল বাঙলার আমজনতা। সাথে ছিল শুধু একবুক সাহস, আর এই সাহস জুগিয়েছিলেন আমাদের বাঙ্গালার বন্ধু আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ঋণ কেউ শোধ করতে পারবে না।
যাঁর চিন্তা চেতনায় সবার আগে এসেছে দেশ, দেশের মানুষ, দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, পেট ভরে ভাত খেতে পাবে, দুর্নীতিমুক্ত সমাজে বাস করবে, দেশের মানুষ শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত হবে। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো একটা দেশ উপহার দিতে চেয়েছে, সেই লক্ষ্যে কাজ করছিলেন তিনি, একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশেকে উনি সাড়ে তিন বছরে সোজা করে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্ত সে হাসি হাসতে পারেন নি। কারণ ৭১’এর দোসররা রয়ে গিয়েছে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, সমাজে, সরকারে। আর তারাই নির্দ্বিধায় খুন করে দেশের একমাত্র বন্ধুকে, বঙ্গবন্ধুকে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৭ মার্চ ২০২০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ পর্যন্ত ২০২০-২০২১ খ্রিস্টাব্দকে মুজিব বর্ষ হিসাবে জাতীয়ভাবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ২৬ মার্চ ২০২১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে। জাতিসংঘের অন্যতম একটি অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো। মুজিব বর্ষ উদযাপনের জন্য ইউনেস্কোর ৪০তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের সাথে যৌথভাবে মুজিব বর্ষ পালন করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা, শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব বর্ষ – এসব একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সৈয়দ শামসুল হক নূরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাটকে যেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথাই লিখে রেখেছেন:
‘দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
নবান্নের পিঠার সুঘ্রাণে দ্যাশ ভরি উঠিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
হামার গাভীন গাই অবিরাম দুধ ঢালিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
মানুষ নির্ভয় হাতে আঙিনায় ঘর তুলিতেছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,
নিশীথে কোমল স্বপ্ন মানুষের চোখে নামিতেছে।…
সুখে দুঃখে অন্নপানে সকলেই একসাথে আছে
সোনার বাংলার সোনা বাংলাদেশে আছে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে প্রাণ না হারাতেন তবে আজ ১৭ তাঁর বয়স হতো ১০১ বছর। তিনি শতায়ু হতেন। আবার কাকতালীয়ভাবে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে বাংলাদেশ তাঁর স্বাধীনতার অর্ধ-শত বার্ষিকীতে পদার্পণ করছে।
কি আশ্চর্য এক মিলের সেতু বন্ধন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তাঁর স্বপ্নের গড়ে ওঠা বাংলাদেশের। কিন্তু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালিকে জাতি হিসেবে আমরা মাত্র ৫৫ বছর ৪ মাস বাঁচতে দিয়েছি। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে শতায়ু তিনি হতেন না, তা কে বলতে পারে! যদি তিনি তাঁর অতি প্রিয় বাংলার মাটিতে শতবর্ষ বেঁচে থাকতেন তবে এই দিনটি জাতি তখন কীভাবে পালন করত, তা ভাবলে মনেপ্রাণে শিহরণ জাগে।
জাতির পিতার জন্মদিনে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
Leave a Reply